এই ‘হাল্লা’ ইজরায়েলের ফৌজ। তাদের দাপটে প্যালেস্তিনীয়রা অন্যায্য বিশ্বব্যবস্থার শিকার। অক্টোবরের শুরুতে হামাসের ভয়াবহ আক্রমণে ১,২০০ ইজরায়েলি নাগরিক হত হয়েছিল। ইজরায়েল তার প্রত্যুত্তরে ১২ হাজার প্যালেস্তিনীয়র প্রাণ কেড়েছে। এই সংখ্যাটা ক্রমে বাড়ছে। এই দুই শক্তির দখলদারির দাঁত-নখের মাঝে ছিন্নভিন্ন বার বার হয়েছে গাজার মানুষই। লিখলেন রুবেন বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই শেষ কয়েক সপ্তাহ যেন চোখের পলকে ফুরিয়ে গেল। আমি কার্যত টেলিভিশনের সঙ্গে সেঁটে ছিলাম সর্বক্ষণ, কাজ থেকে ফিরেই ক্রিকেট বিশ্বকাপের উত্তেজনার পারদ-চড়ানো ম্যাচগুলি দেখতে বসে যেতাম। এর মাঝে আবার একদিন আয়েশ করে পপকর্ন চিবোতে চিবোতে শাহরুখ খানের ‘জওয়ান’-ও দেখেছি হলে বসে। বেশ কয়েকবার পরিবারের সঙ্গে নৈশাহার সারতেও গিয়েছি নানা রেস্তরাঁয়।
দুর্ভাগ্যবশত, এই কাজগুলি সচরাচর যে আনন্দ আমাকে দিয়ে এসেছে, তা কিন্তু আমি এই কদিনে পাইনি। আমার আনন্দ মাটি হয়ে গিয়েছে মূলত আমার অপরাধবোধের দাক্ষিণ্যে, যা আমাকে সর্বক্ষণ দহন করেছে। যখন আমার অদূর অতীতের সহকর্মীরা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন জীবনের ক্ষুদ্র আনন্দগুলির পিছনে ধাওয়া করে চলাকে অপরাধই বলতে হবে, নিদেনপক্ষে তা অনৈতিক আচরণ তো বটেই। সেই নিরিখে আমি অপরাধী।
[আরও পড়ুন: করোনার পর এবার ‘রহস্যজনক’ নিউমোনিয়া! নয়া আতঙ্কে কাঁপছে চিন, সতর্ক করল WHO]
গাজায় (Gaza) হাজারে হাজারে প্যালেস্তিনীয় নিহত হচ্ছে। তাদের উপর নেমে আসছে ইজরায়েলের হিংস্র আক্রমণ। ইজরায়েলে (Israel) অনুপ্রবেশ করে সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস যে নিষ্ঠুর হামলা চালিয়েছিল, তার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নির্বিচারে রক্ত ঝরাচ্ছে ইজরায়েলও। একটি ঘৃণ্য গণহত্যার জবাবে আরও নির্মম, আরও তীব্র গণহত্যার খাঁড়া নেমে এল। আমার আশঙ্কা, আমার প্যালেস্তিনীয় সহকর্মীদের বন্ধুস্বজনরাও এই যুদ্ধের শিকার হচ্ছেন।
দোহায় আল-জাজিরার সদর দফতর যেন ছিল একটা ছোটখাট রাষ্ট্রসংঘ। সেখানে আমার ১২টা বছর কেটেছে। প্রায় সব দেশের মানুষ ছিলেন ওই অফিসে, যার মধ্যে ভারতীয়রা তো ছিলেনই, পাশাপাশি ছিলেন মার্কিন, ইজিপ্সীয়, মরক্কান, সিরীয় এবং অস্ট্রেলীয়রা। বহু প্যালেস্তিনীয়ও কাজ করতেন ওই অফিসে।
[আরও পড়ুন: ‘রাজ্য, কেন্দ্র দুই সরকারের এজেন্সির বিরুদ্ধেই লড়াই চলছে’, সোশাল মিডিয়া পোস্ট কুণালের]
প্যালেস্তিনীয় নাগরিকরা, সেখানকার নারী-শিশু, আক্রান্ত হচ্ছেন, নিহত হচ্ছেন, কিন্তু দুনিয়া মুখ ঘুরিয়ে রয়েছে। এই কলঙ্ক মোচন করতে মানবতার সময় লাগবে। এই রক্তপাত বন্ধ না করতে পারার ব্যর্থতা আমাদের সমষ্টিগত লজ্জা। এই ধ্বংসের দায়ভাগে আমি, আপনি, আমরা সবাই– যারা এই বীভৎসতার সামনে নিষ্ক্রিয় হয়ে আছি।
প্যালেস্তিনীয়দের প্রতি সহমর্মী হওয়ার নেপথ্যে কারণ আছে। তাদের সঙ্গে আমি থেকেছি, কাজ করেছি। তাদের ‘বন্ধু’ হয়ে উঠেছি, তাদের ভালবেসেছি। আবার তাদের কাউকে কাউকে আমি অপছন্দও করেছি। যেমন বিশেষ করে আমার প্যালেস্তিনীয় ঊর্ধ্বতন কর্তার কথা মনে পড়ে, যিনি ছিলেন দুর্বিনীত ও অকর্মণ্য। কিন্তু সেসব ব্যক্তিগত সংস্কার সরিয়ে রেখে এ-কথা নির্দ্বিধায় বলতেই হয়, প্যালেস্তিনীয়রা, যার মধ্যে আমার সহকর্মীরাও আছে, এক অন্যায্য বিশ্বব্যবস্থার শিকার।
১৯৪৮ সালে ইজরায়েল তৈরি হওয়ার সময় নিজের শিকড় ছেড়ে, ঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল প্যালেস্তিনীয়রা। তাদের প্রজন্মর-পর-প্রজন্ম দূরের দেশে বেড়ে উঠেছে শরণার্থী হিসাবে। তারা উদ্বাস্তু হয়ে থেকেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আবার কখনও হয়তো সিরিয়া, জর্ডন বা কাতারের মতো পড়শি দেশে। কিন্তু কেউ-ই সেই অভিবাসনের, দেশ ছেড়ে যাওয়ার– যাকে ওখানকার ভাষায় বলে ‘নাকবা’– ক্ষতগুলো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাদের বহন করে যেতে হয়েছে সেই জখম।
সেই থেকেই প্যালেস্তিনীয়দের সময় ক্রমে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে। ইজরায়েলের যত সঁাজোয়া দাপট বেড়েছে, যত এলাকা তাদের দখলে এসেছে– প্যালেস্তিনীয়দের বসবাসের ভূখণ্ড ততই সংকুচিত হতে থেকেছে। দারিদ্র তো ছিলই, ক্রমে প্যালেস্তিনীয়রা তলিয়ে গিয়েছে অসম্মানের এক অদ্ভুত অঁাধারে।
সম্ভবত পৃথিবীর সবথেকে বেশি জনঘনত্ব গাজার ওই একটুকরো ভূখণ্ডে। ইজরায়েলের অবরোধ-আক্রমণ দেশটাকে যেন পঙ্গু করে রেখেছে। গাজায় প্রবেশ ও প্রস্থান এখন প্রায় অসম্ভব। এই দেশে জ্বালানি, শিশুখাদ্য এবং ওষুধের জোগানও এই মুহূর্তে ইজরায়েলের কড়া নজরদারি এবং তাদের করুণার অধীনে। কেবলমাত্র ওয়েস্টব্যাঙ্কের প্যালেস্তিনীয়রা প্রান্তিকভাবে হলেও, ভাল আছে। অন্তত তা গাজার মতো এক খুল্লমখুল্লা কয়েদখানা হয়ে ওঠেনি। সরকারিভাবে অন্তত, প্যালেস্তাইনের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এখানে। কিন্তু মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন সেই প্যালেস্তিনীয় কর্তৃপক্ষ আদতে ঠুঁটো জগন্নাথ, কাগুজে বাঘ। ১৫ বছর হল নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসাবে আব্বাসের মেয়াদ ফুরিয়েছে। তাও এই অথর্ব বয়সেও তিনি ক্ষমতা ধরে রেখেছেন।
এই অবৈধতা এবং অপদার্থতার ফঁাকতাল গলে, প্রয়োজনে সেই ফসকা গেরোকে আরও বাড়তে দিয়ে, ইজরায়েল কায়েম করে চলেছে ওয়েস্টব্যাঙ্কের ভূখণ্ড। এর ফলস্বরূপ সেখানে প্রতিপদে নাকাবন্দি চলছে, যা প্যালেস্তিনীয় জনগণের জীবনযাপন অসহনীয় করে তুলেছে। সাম্প্রতিক অতীত জুড়ে, সাধারণ প্যালেস্তিনীয়দের, যার মধে্য আমার প্রাক্তন সহকর্মীরাও রয়েছে, নিজেদের ভবিতব্য নিয়ে কিছুই প্রায় বলার ছিল না। প্যালেস্তিনীয়দের নিজের দেশ ফিরিয়ে দিয়ে কোনও দ্বিপাক্ষিক সমাধানে যাওয়ার বিষয়ে ইজরায়েলের কোনও আগ্রহই নেই। এই জটিল সমস্যার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সমাধান হিসাবে এককালে যা বিবেচিত হত, আরব রাষ্ট্র-সহ বিশ্ব জুড়ে অন্যান্য শক্তি তাকে যেন নিশ্চুপে কবর দিয়ে দিয়েছে।
বারবার অবদমিত হতে-হতে প্যালেস্তিনীয়দের সিংহভাগই এখন নীরব দর্শকে পর্যবসিত। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পাকেচক্রে হামাসের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠী ময়দানে নেমেছে।ইজরায়েলের প্রতি বিদ্বেষ থাকলেও, গাজার নাগরিকরা কিন্তু প্রত্যেকে হামাসকে সমর্থন করে না। কিন্তু মাঝেমধে্যই সশস্ত্র প্যালেস্তিনীয় গোষ্ঠীগুলি ইজরায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষে গিয়েছে। সাম্প্রতিক রক্তঝরানো এই সংঘাত প্রথম নয়, এবং এখানেই এই সংঘাত শেষও হবে না।
২০০০ থেকে এখনও পর্যন্ত পঁাচবার বিভিন্ন ঘটনাক্রমে হামাসের সঙ্গে ইজরায়েলের সহিংস সংঘাত হয়েছে, যা বারবার গাজায় ধ্বংসলীলার নরকদ্বার খুলে দিয়েছে। এই দুই শক্তির দখলদারির দঁাত-নখের মাঝে ছিন্নভিন্ন বারবার হয়েছে গাজার মানুষই। এখনও তা-ই ঘটে চলেছে। অক্টোবরের শুরুতে হামাসের ভয়াবহ আক্রমণে ১,২০০ ইজরায়েলি নাগরিক হত হয়েছিল। ইজরায়েল তার প্রতু্যত্তরে ১২,০০০ প্যালেস্তিনীয়র প্রাণ কেড়েছে। এই সংখ্যাটা ক্রমে বাড়ছে।
এই হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী থেকে যোজন-যোজন দূরে বসে আমি কেবলই আশা করতে পারি, প্রার্থনা করতে পারি, আমার প্রাক্তন সহকর্মীরা, তাদের বন্ধু ও পরিবারবর্গ যেন অক্ষত থাকে। আমার প্রার্থনা তাদের সঙ্গে থাকবে, আমি যদিও আমার নিত্যযাপনে দিব্য ব্যস্ত থাকব।
(মতামত নিজস্ব)
Source: Sangbad Pratidin