অর্থনীতির জন্য সামাজিক শান্তি জরুরি

প্রযুক্তি-নির্ভর যুগেও ভারতীয় নাগরিকদের মনে এই ধারণা বহাল যে, পুলিশে ছুঁলে বাইশ ঘা! পুলিশ কোনও ‘সমস্যা’ নয়; বরং ‘সমাধান’, এই ধারণা গড়ে ওঠা জরুরি। কলমে নীল সরকার
 
ফ্রান্স, মার্কিন মুলুক, বিলেতের থেকে ভারত অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে। বছরভর বিভিন্ন মাপকাঠিতে দেশের অবস্থান নানা সমীক্ষায় উঠে আসে। তেমনই সম্প্রতি প্রকাশিত এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে একটি তথ্য। যেখানে বলা হয়েছে ঘটে চলা অপরাধের মাপকাঠিতে ভারতের অবস্থান ভাল। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? যদিও এই ধরনের সমীক্ষার বাস্তবতা নিয়ে চিরকালই ভারতে বিতর্ক বহাল।
ভারতে ১৭৯৩ সালে ৪৮ নম্বর রেগুলেশনের দৌলতে লর্ড কর্নওয়ালিসের হাত ধরে ইংরেজ ঘরানার এই পুলিশি ব‌্যবস্থার সূচনা। পুলিশ প্রথম থেকেই প্রশাসনের ‘বখাটে’ ছেলে। যখনই অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা আসে, প্রথম ধাক্কাটা খায় পুলিশ। কারণ, তারা জনতার হাতের নাগালের মধ্যে পেয়ে যাওয়া সরকারের প্রতিনিধি। স্বাধীনতার পর থেকেই সংবিধান মোতাবেক রাজ্যগুলির হাতে আইন-শৃঙ্খলার ভার ওঠে। যদিও এটা সত্যি যে, ভারতের অঙ্গরাজ‌্যগুলির পুলিশ কখনওই ধারে ও ভারে উন্নত দেশের পুলিশের সমতুল নয়। এখানকার পুলিশি ব‌্যবস্থার কিছু সমস্যাও চিরকালীন।
প্রথমেই উঠে আসে, জনতা-পুলিশ অনুপাত। জাতিপুঞ্জের সর্বশেষ হিসাব অনুসারে, সংশ্লিষ্ট অনুপাতে লাখে ২২২ জন (পুলিশ) থাকা উচিত, যা নেই। সর্বোচ্চ আদালতে প্রকাশ সিং-এর ২০০৬ সালের রায় ঘোষণার পরও ‘আইনশৃঙ্খলা পুলিশ’ ও ‘অপরাধ নিবারণকারী’ পুলিশ এখনও পৃথক করা হয়নি বহু রাজ্যে। শহর ও গ্রামের অনুপাতের সাম্য বিরল। কিন্তু জনতা-পুলিশ অনুপাত লাখে ১৯৫ জন। উত্তর-পূর্ব ভারতে ভিন্ন কারণে ৫০০ থেকে ১০০০। আবার বিহারে মাত্র ৮১! এদিকে, প্রশাসনের সিদ্ধান্ত একমুখী। যে-দারোগা ঘটনাস্থলে থেকে কাজ করছে, তার মতপ্রকাশের অধিকার সীমিত। বিভিন্ন প্রভাব ঠেকানোর মতো আইনি সুরক্ষাও বিরল। ফলে, পুলিশ তার উপরওয়ালার কথাকেই ‘আইন’ হিসাবে মেনে নেয়।
পরের প্রশ্ন আইন। ১৮৩৪-’৩৮ সালে টমাস ব্যাবিংটন মেকলে দ্বারা নির্মিত হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আইন। যার মূল মন্ত্র ছিল, সস্তায় সুবিচার। কারণ, এই ব্যবস্থার নেপথ্যের যা ব‌্যয়, তা আলাদা করে কোম্পানির কোনও উপকারে লাগত না। সামাজিক ন্যায় প্রদানের থেকে নজর ছিল ব্যবসায়িক লাভে।
সেই মান্ধাতা আমলের আইনি কাঠামো ছিল পরিকাঠামোগতভাবে ভীষণই দুর্বল, এবং দুর্ভাগ্যক্রমে যা এখনও বহাল। নাগরিকদের পরিষেবা নিতে গেলে নিজেদের রেস্ত খসিয়ে থানায় উপস্থিত হতে হবে, বা আদালতে আইনজীবী ধরে দরখাস্ত জমা করতে হবে। অনলাইন ব‌্যবস্থা চালু হলেও তা এখনও প্রান্তিক নাগরিকদের নাগালের বাইরে। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল রেখে আইনের সংস্কার সেভাবে হয়নি। ফলে আইন সম্পর্কে এখনও সাধারণ মানুষের পরিষ্কার ধারণা তৈরি হয়নি। এই ধোঁয়াশা থাকায় বহু মানুষ অজানা শঙ্কায় আইনের চৌকাঠ এড়িয়ে চলে। ফলে, চটজলদি সুরাহা মেলাও এককথায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। সাক্ষীদের সুরক্ষা নিয়েও এখনও নির্দিষ্ট আইনি কাঠামো তৈরি হয়নি। ফলে তদন্তে সাক্ষ্য জোগাড় করা যেরকম ঝকমারি ছিল, সেরকমই রয়ে গিয়েছে।
তবে, অপরাধ জগৎ খুব দ্রুত বদলাচ্ছে। একদিকে সাইবার অপরাধ যেমন লাফিয়ে বাড়ছে, তেমনই প্রথাগত সম্পত্তি-নির্ভর অপরাধ কমছে। ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই কমের দিকে। বাড়িতে ডাকাতি শূন্যর কাছে। পকেটমারি অবলুপ্ত এক শিল্প। মানিব্যাগে কেই বা টাকা রাখে আজকাল?
নাগরিক এখন সংবাদ ও সামাজিকমাধ্যম সচেতন। সিসিটিভি ক্যামেরা আসামি শনাক্তকরণে বড় ভূমিকা নিচ্ছে। তার উপর ভিত্তি করে সাজাও হচ্ছে বিস্তর। বিজ্ঞাননির্ভর সাক্ষ্য-প্রমাণ জোগাড়ে জোর দেওয়ায় মানবিক সাক্ষীর পাল্টি খাওয়া কমে এসেছে।
সঙ্গে যোগ করতে হবে, তথ্য বিশ্লেষণে প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়টিও। এখন পুরনো খাতা ঘেঁটে কোনও অপরাধী সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করতে হয় না। অ‌্যাপেই সব তথ‌্য পাওয়া যায়। ‘সিসিটিএনএস’-এর (ক্রাইম অ‌্যান্ড ক্রিমিনাল ট্র‌্যাকিং নেটওয়ার্ক অ‌্যান্ড সিস্টেম) মতো ব‌্যবস্থার মাধ‌্যমে থানাগুলো এখন খুব দ্রুত খবর আদান-প্রদান করতে পারছে। জাতীয় অপরাধ তথ্যভাণ্ডারও ভরে উঠছে, বলা বাহুল‌্য। এরপর ‘এআই’ ও ‘৫-জি’ পুরোদমে চালু হলে কাজের গতি বিপুল হারে বাড়বে।
একসময় ভারতে অপরাধপ্রবণতার মূল কারণ হিসাবে ধরা হত মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থান। ‘অপরাধ’ হিসাবে গণ‌্য হত মূলত ধনসম্পদ ও শারীরিক হামলা। জনসংখ্যায় আমরা এখন দুনিয়ার শীর্ষে। শারীরিক হামলা বেড়েই চলেছে। তবে হামলাকারী ধরাও পড়ছে। কাজে লাগছে প্রযুক্তির ব্যবহার। তবে ধর্ষণ প্রসঙ্গে বলতে হয়, এই অপরাধ নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু মানসিকতার পরিবর্তন না হলে বিপদ।
দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে চর্চা কম হচ্ছে। ড্রাগ, নারী নির্যাতনের মতো ঘৃণ‌্য অপরাধ একেবারে শূন্য করা না গেলেও এজাহার দাখিল ও তদন্ত চলছে। বছরে ২ কোটি ৪০ লাখের উপর এজাহারের তদন্ত করা কম কথা নয় কিন্তু!
অপরাধ দমনে বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্প, যেমন, ১০০ দিনের কাজ, পঞ্চায়েতের বিভিন্ন কর্মসূচি ফলপ্রসূ হচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষিত নাগরিকদের মধ্যে দ্রুত বড়লোক হওয়ার একটা প্রবণতা প্রকট হয়েছে। ফলে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে লোকজন নেমে পড়েছে টাকার খোঁজে। এই প্রবণতা পুলিশের কাছে হয়ে উঠছে চিন্তাজনক। ‘সাদা রং’-এর অপরাধ তাই জটিলতর হচ্ছে থানা-পুলিশের কাছে। ‘উন্নত দেশ’-এর তকমা পেতে ভোগবাদের এই রোগের উল্লেখ ইতিহাসে কম নেই।রইল বাকি বিচারবিভাগের গতি ও সংস্কার। সেই সমস্যা রাষ্ট্রের নজরে আছে। তবে তা কোন উপায়ে আমজনতার নাগালে আনা যাবে, তা ভাবার সময় এসেছে।
এই প্রযুক্তির যুগে কেন নাগরিকদের মনে এখনও এই ধারণা বহাল থাকবে যে পুলিশে ছুঁলে বাইশ ঘা! পুলিশ কোনও ‘সমস্যা’ নয়; বরং ‘সমাধান’- এই ধারণা গড়ে ওঠা জরুরি। তেমনই আদালত নিয়েও নাগরিকদের অস্বস্তি নিরসন হওয়া কাম‌্য। কেন ফিজ দেওয়ার ভয়ে বিচার চাইতে শঙ্কিত হবে মানুষ?
মোটকথা, এতদিন ভারত একটা সুস্থ সামাজিক পরিবেশ ধরে রেখেছে। বড় ধরনের কোনও অস্থিরতা তৈরি হয়নি। এই শান্তির পরিবেশ বিনিয়োগের জন্যও আবশ্যক। পাঁচ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির জন্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও আইনশৃঙ্খলার স্থিরতা তাই অত্যাবশ্যক- বলা বাহুল‌্য।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক
sarkarnil91@gmail.com

Source: Sangbad Pratidin

Related News
ফের ভাঙবে পাকিস্তান! বিশ্বজুড়ে ‘স্বাধীনতা দিবস’ পালন প্রবাসী বালোচদের
ফের ভাঙবে পাকিস্তান! বিশ্বজুড়ে ‘স্বাধীনতা দিবস’ পালন প্রবাসী বালোচদের

সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: পাকিস্তান ভেঙে তৈরি হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। সেই ধাক্কা আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারা। এবার ইসলামাবাদের শাসনের Read more

নির্বাচনী আচরণবিধি লাগু হওয়ার পরও কেন প্রশাসনিক বৈঠক? মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে প্রশ্ন বিরোধীদের
নির্বাচনী আচরণবিধি লাগু হওয়ার পরও কেন প্রশাসনিক বৈঠক? মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে প্রশ্ন বিরোধীদের

বুদ্ধদেব সেনগুপ্ত: রাজ্যে পুরভোটের (Municipal Election)আগে আদর্শ আচরণবিধি লাগু হওয়ার পরও কীভাবে প্রশাসনিক বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী? প্রশাসনিক বৈঠক নিয়ে প্রশ্ন Read more

‘অস্তিত্ব বিপন্ন হলে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করবে রাশিয়া’, হাড়হিম করা হুমকি ক্রেমলিনের
‘অস্তিত্ব বিপন্ন হলে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করবে রাশিয়া’, হাড়হিম করা হুমকি ক্রেমলিনের

সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে আতঙ্কিত ইউরোপ। ভূ-কৌশলগত সমীকরণের জটিল ধাঁধা নিয়ে ব্যস্ত এশিয়া। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি করে Read more

একমাসের মধ্যে ফের এনকাউন্টার উত্তরপ্রদেশে, মৃত কুখ্যাত গ্যাংস্টার অনিল দুজানা
একমাসের মধ্যে ফের এনকাউন্টার উত্তরপ্রদেশে, মৃত কুখ্যাত গ্যাংস্টার অনিল দুজানা

সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ফের এনকাউন্টার। ফের এক গ্যাংস্টারের মৃত্যু উত্তরপ্রদেশে (Uttar Pradesh)। জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার দুপুরে মেরঠের একটি গ্রামে Read more

চা বাগানের শ্রমিকদের নিয়ে রাজ্যে প্রথম সম্মেলন, রবিবার মালবাজারে বার্তা অভিষেকের
চা বাগানের শ্রমিকদের নিয়ে রাজ্যে প্রথম সম্মেলন, রবিবার মালবাজারে বার্তা অভিষেকের

সংবাদ প্রতিদিন ব্যুরো: চা-শ্রমিকের স্বার্থরক্ষায় তাদের সংঘবদ্ধ করে লড়াই। লক্ষ‌্য গোষ্ঠী উন্নয়ন। যে লড়াইয়ের প্রস্তুতিতে রবিবার মালবাজারে চা বাগানের শ্রমিক Read more

কুন্তলের চিঠি মামলা: জেরা থেকে অব্যাহতি চেয়ে ফের হাই কোর্টে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
কুন্তলের চিঠি মামলা: জেরা থেকে অব্যাহতি চেয়ে ফের হাই কোর্টে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়

সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ধৃত কুন্তল ঘোষের (Kuntal Ghosh) চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে জেরা থেকে অব্যাহতি চেয়ে ফের Read more