সামনের বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে ভোট। বিএনপি-র দাবি, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্য তদারকি সরকার গঠন করতে হবে। মার্কিন প্রশাসনের একাংশও তদারকি সরকারের পক্ষে। যদিও এই প্রস্তাবকে ‘অসাংবিধানিক’ বলেছে শেখ হাসিনা সরকার। চিনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা আমেরিকার চোখের বালি। ভারত এ ধারণা ভাঙতে তৎপর। কলমে জয়ন্ত ঘোষাল
এরশাদ ১৯৯১ সালে ‘তদারকি সরকার’ গঠন করেন। ’৯৬ সালে খালেদা এটি বাদ দেন। তখন আওয়ামি লিগ তদারকি সরকার চায়। ২০০৭-এ খালেদা তদারকি সরকার করতে বাধ্য হন। কিন্তু ২০০৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করে রায় দিয়ে দেয় যে, তদারকি সরকার অসাংবিধানিক। সে-কাহিনি এখন অতীত।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে ভোট। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজি হাবিবুল আউয়াল এই ঘোষণা করেছেন। শুধু তা-ই নয়, এই ভোটে তিনি সমস্ত রাজনৈতিক দলকে অংশ নিতেও অনুরোধ করেছেন। প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ৩০ নভেম্বর।
ঢাকায় নির্বাচনের দিন-ক্ষণ ঘোষণা হল এমন এক সময়, যখন বিএনপি-র দাবি, এই বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহার করতেই হবে। খালেদা ও জামাতের দাবি- অবাধ, শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্য আগে ‘তদারকি সরকার’ গঠন করতে হবে। আমেরিকার প্রশাসনের একাংশও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করার পক্ষে। আওয়ামি লিগ অবশ্য জানিয়ে দিয়েছে যে, ঢাকার সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন তদারকি সরকারের কোনও সুযোগ নেই। কাজেই এ প্রস্তাব অসাংবিধানিক। পাকিস্তানের সংবিধানে তদারকি সরকারের কথা থাকলেও বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্টের সুনির্দিষ্ট রায়ের পর এ সম্ভাবনা নেই।
এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে কী করবে বিএনপি?
২০১৪ সালে বিএনপি ভোট বয়কট করে। এবার কী করবে বিএনপি যদি আমেরিকা তদারকি সরকার গঠনে চাপ সৃষ্টির কূটনীতি থেকে শেষ পর্যন্ত সরে আসে, ভারতও যেটা চাইছে, তাহলে কি আবার বিএনপি ভোট বয়কটের পথে হাঁটবে? তাতে অবশ্য আখেরে আওয়ামি লিগেরই লাভ। এককভাবে হাসিনা-ই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসবেন। এবারও বিএনপি ভোটে যোগ না-দিলে তাদের দলের সংগঠনকে জেলায় জেলায় ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। স্বাভাবিকভাবে বিএনপি ভেঙে অনেকে আওয়ামি লিগে চলে আসবেন টিকিট পেতে।
খালেদা জিয়া এখন গৃহবন্দি। অসুস্থ। বয়স ৭৮। বিদেশে চিকিৎসায় যাওয়ার ছাড়পত্র পাননি। বিএনপি ও জামাত বাংলাদেশে ভোট-বিরোধী বিক্ষোভকে আক্রমণাত্মক করতে চাইছে। সরকার-পুলিশকে প্ররোচনার ফঁাদে ফেলা যাতে সরকার দমনমূলক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়। যাতে চূড়ান্ত নৈরাজ্য ও সন্ত্রাসের যুক্তিতে বাংলাদেশে ভোট বাতিল করা সম্ভব হয়।এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, আমেরিকা কী চাইছে? একটা ধারণা জনপ্রিয় হয়েছে যে, আমেরিকা শেখ হাসিনা সরকারের একনায়কতন্ত্রী মানসিকতায় ক্ষুব্ধ। আমেরিকা ভোটের বদলে ‘তদারকি সরকার’ গঠনে আগ্রহী। এজন্য বাংলাদেশে অবাধ ভোট না-হলে আমেরিকা বাংলাদেশের ভিসা বাতিল করবে। আমেরিকা এই নয়া ভিসা নীতি ঘোষণাও করে। এই ব্যাপারে হঁাড়ির খবরটা আসলে কী? সত্যি-সত্যিই কি আমেরিকা হাসিনার বদলে বিএনপির শাসন চাইছে? বাংলাদেশের ও ভারতের বহু বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলার পর আমার যা ধারণা হল, সেগুলি সূত্রাকারে আপনাদের জানাই-
১) আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সর্বক্ষণ বাংলাদেশে কী হচ্ছে, তা জানতে আগ্রহী নন। বাংলাদেশের ভোট বিএনপির অগ্রাধিকার, হোয়াইট হাউসের জন্য নয়।
২) প্রাক্তন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিন্টনের এখনও এই ডেমোক্রেটিক শাসনে প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে যা ট্রাম্পের রিপাবলিক জমানায় ছিল না। হিলারি ব্যক্তিগতভাবে নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনুসের বিশেষ সমর্থক। এজন্য বাংলাদেশে ইউনুসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে কিছু নোবেলজয়ী সেই দুর্নীতির তদন্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বিবৃতি জারি করেন। আর সেই যৌথবিবৃতিকে সমর্থন করে টুইট পর্যন্ত করেন হিলারি! ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হিলারি ফাউন্ডেশন ও ইউনুসের ‘গ্রামীণ ব্যাঙ্ক’ সংস্থার মধে্য। এখনকার বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সালিভান অতীতে হিলারির অধস্তন ছিলেন। হোয়াইট হাউস বা পেন্টাগন না থাকলেও তাই স্টেট ডিপার্টমেন্টের একাংশ হাসিনা-বিরোধী অবস্থান নিয়েছিল।
‘টাইম’ পত্রিকার প্রচ্ছদ নিবন্ধে হাসিনার স্বৈরাচারের কথা লেখা অথবা ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’-এর প্রতিক্রিয়া এই কৌশলের অঙ্গ। এমনকী, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রশংসা করা হলেও ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বিশ্বব্যাঙ্ক এবং আন্তর্জাতিক অর্থ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকেও অবাধ নির্বাচনের শর্ত আরোপ করেন বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশ্নে।
৩) শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের একাংশের এই বিরোধিতা
কিন্তু হঠাৎ নয়। অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন কূটনীতিক জন ড্যানিলোভিচ, পাকিস্তানে একদা পোস্টেড ছিলেন ২০১৪ সালের ভোটের সময়, ছিলেন ঢাকায় ‘ডেপুটি চিফ অফ দ্য মিশন’। তিনি এখন খুবই সক্রিয় এই হাসিনা-বিরোধী প্রচারে। লন্ডন থেকে প্রকাশিত এক সংবাদমাধ্যমে তিনি নিয়মিত বিএনপি ও জামাতের পক্ষে লিখে চলেছেন। শেখ হাসিনা খুবই মুনশিয়ানার সঙ্গে আমেরিকার এই রণকৌশলের মোকাবিলা করেছেন। বাংলাদেশের সংসদেও তিনি মার্কিন দাদাগিরির কঠোর সমালোচনা করার সাহস দেখান। তবে ‘জি২০’ সম্মেলনে দিল্লিতে জো বাইডেন তঁার সঙ্গে সেলফি তুলতে অসম্মত হননি।
[আরও পড়ুন: ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধে কি গদি টলমল বাইডেনের?]
বাংলাদেশের অনেকে এ প্রশ্ন করছেন, ভারত যদি এত বন্ধুই হয় তবে আমেরিকাকে কেন বোঝাচ্ছে না, কেন চাপ সৃষ্টি করছে না! এ ব্যাপারে সাফ কথা হল, ভারত একবার নয় বারবার আমেরিকাকে বোঝাচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে চিন বেশি বন্ধুত্ব করছে আমেরিকা এমন একটি ধারণা পোষণ করে। ভারত অবশ্য আমেরিকাকে বোঝাতে চাইছে- বাংলাদেশের বিদেশনীতি (‘বঙ্গবন্ধু’ মুজিবুর রহমান যার স্থপতি) অনুসারে বাংলাদেশের কোনও শত্রু রাষ্ট্র নেই। দুটো দেশের মধ্যে ঝগড়া থাকলে বাংলাদেশ একপক্ষর হয়ে অন্যপক্ষর বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে না।
এবার দিল্লিতে ‘জি২০’-র সময়ও আমেরিকাকে বুঝিয়েছে ভারত, কেন প্রতিবেশী বাংলাদেশের ভোটে আমেরিকার নাক গলানো ভারত পছন্দ করছে না। চিন-পাকিস্তান অক্ষকেই শক্তিশালী করা হবে- যদি এখন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এহেন ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করা হয়।
সেদিন ভারতের বিদেশমন্ত্রকের এক বড়কর্তা বলছিলেন, প্রকাশ্যে বাংলাদেশ নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে ঝগড়া করাটা আমাদের লক্ষ্য নয়। কূটনীতির সাফল্য আসে গোপনে কার্যসিদ্ধির মাধ্যমে। আমেরিকার ইগোয় আঘাত না-করে ওদের অস্ত্র দিয়েই ওদের সঙ্গে বোঝাপড়া হচ্ছে।
ভোট ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। আমেরিকার বহু বাংলাদেশি ভোটাধিকার পেয়েছে। এই অনাবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে জামাত-বিএনপি প্রেম বেড়েছে। এই ভোটব্যাঙ্ককে খুশি রাখতেও আমেরিকা সক্রিয়। ভারত এক্ষেত্রে কানাডার উদাহরণ দিয়ে আমেরিকাকে সাবধান করেছে। কারণ, মৌলবাদীদের হাতে তামাক খাওয়া বড় বিপজ্জনক। তদারকি সরকারও হতে পারে না। কারণ? এরশাদ ১৯৯১ সালে ‘তদারকি সরকার’ গঠন করেন। ’৯৬ সালে খালেদা এটি বাদ দেন। তখন আওয়ামি লিগ তদারকি সরকার চায়। ২০০৭-এ খালেদা তদারকি সরকার করতে বাধ্য হন। কিন্তু ২০০৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করে রায় দিয়ে দেয় যে, তদারকি সরকার ‘অসাংবিধানিক’। সে-কাহিনি এখন অতীত। বিএনপি যদি ভোট প্রক্রিয়ায় যোগ দেয় তাতেও ভারতের কোনও অসুবিধা নেই। বরং বিএনপি যোগ দিলে দুনিয়ার সামনে শেখ হাসিনার ভোট ও কর্তৃত্বর বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে এই কমবে না। সেটা অবশ্য এখন বিএনপির কোর্টে।
সব ভাল যার শেষ ভাল তার। ‘বঙ্গবন্ধু’-র তৈরি করা বাংলাদেশি জাতীয় পতাকার চারটি লাল তারা ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদের প্রতীক। প্রতিবেশী এই বন্ধু-রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক চিরস্থায়ী হোক- এই প্রত্যাশা।
[আরও পড়ুন: বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অতিসক্রিয় আমেরিকা, চিন্তিত ভারত]
Source: Sangbad Pratidin