দেবালয় পুড়ছে, মণিপুরে পুড়ছে জনপদও, এই হিংসার শেষ কোথায়?

আপাতত নিয়ন্ত্রণে এলেও মণিপুরের সাম্প্রতিক ভয়াবহ জাতি-দাঙ্গা কোথায় গিয়ে শেষ হবে, তা এখনও অস্পষ্ট। জাতি-দাঙ্গায় ধর্মের রং লেগেছে। মেইতেইদের সিংহভাগ বৈষ্ণব। কুকি উপজাতিরা খ্রিস্টান। দাঙ্গায় মন্দির ও চার্চ, দুই-ই পুড়েছে যথেচ্ছ! কলমে সুতীর্থ চক্রবর্তী
 
কাশ্মীর নিয়ে যে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্বেগের শেষ নেই, তারা অদ্ভুতভাবে নীরবতা পালন করছে মণিপুরের ক্ষেত্রে। গত কয়েক দিন ধরে উত্তর-পূর্বের এই ছোট্ট রাজ‌্যটিতে যে ধরনের জাতি-দাঙ্গা চলছে, তা সাম্প্রতিককালে দেশের অন‌্য কোথাও দেখা যায়নি। প্রকাশ্যে একে ৪৭-এর মতো অস্ত্র নিয়ে দাঙ্গাকারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সরকারি হিসাবে প্রায় ৬০ জনের প্রাণ গিয়েছে। নিহতদের তালিকায় জাতীয় স্তরের খেলোয়াড় থেকে সরকারি আধিকারিক, আধাসেনার কমান্ডো প্রমুখ রয়েছেন। আক্রান্ত হয়েছেন একজন বিধায়কও। হাজার হাজার মানুষ ঘরছাড়া। তবুও দেখা গিয়েছে কর্ণাটক নির্বাচন নিয়ে ব‌্যস্ত দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-সহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার প্রবীণ সদস‌্যরা। তাঁরা কেউ মুখ খোলেননি মণিপুর নিয়ে। অথচ, মণিপুরে ডাবল ইঞ্জিন সরকার।
জনসংখ‌্যার নিরিখে মণিপুর একটি অত‌্যন্ত ছোট রাজ‌্য। মেরেকেটে এই রাজ্যের বাসিন্দার সংখ‌্যা ৩৫ লক্ষের বেশি নয়। কিন্তু এই ৩৫ লক্ষের মধ্যে রয়েছে প্রায় ৩৫টি জনজাতি সম্প্রদায়। রয়েছে একাধিক ধর্মের মানুষও। হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সংখ‌্যা প্রায় সমান-সমান। সাড়ে ৮ শতাংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষও রয়েছে। প্রায় ১০ শতাংশ এমন একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে, যাদেরকে হিন্দু-পূর্ববর্তী ধর্ম সম্প্রদায় বলা হয়ে থাকে। অল্প জনসংখ‌্যা, কিন্তু অসম্ভব বৈচিত্রময় এই রাজ্যের একটা দীর্ঘ ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ‌্যও রয়েছে। আবার স্বাধীনতার পর থেকে মণিপুর হল উত্তর-পূর্ব ভারতের এমন একটি অঞ্চল, যেখানে সবসময় অশান্তি লেগেই রয়েছে। বৈচিত্রে‌র মধ্যে ঐক‌্য রক্ষা করা যে কতটা কঠিন, সেটা সবসময় স্মরণ করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’-র এই রাজ‌্য।
মণিপুরে বিভিন্ন জনজাতি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ও ভয়ংকর সন্ত্রাসবাদী লড়াই চালিয়েছে এই রাজ্যের নাগা-তাঙ্খুল উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ। কংগ্রেস আমলে নাগা-তাঙ্খুল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি রিশাং কেইশিং দীর্ঘদিন মুখ‌্যমন্ত্রী ছিলেন। এই রিশাং কেইশিংয়ের সঙ্গে মণিপুরের নাগা-অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিভ্রমণের সুযোগ ঘটেছিল একবার। পাহাড় এলাকার নাগা গ্রামগুলিতে ঘুরলে বোঝার উপায় নেই যে, আদৌ এই অঞ্চলগুলি দেশের সীমানার মধ্যে কি না। আইজ‌্যাক ও মুইভার এনএসসিএন-এর অনুগামীরা এসব অঞ্চলে কার্যত সার্বভৌম ক্ষমতা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
[আরও পড়ুন: মণিপুরে ‘হকের লড়াই’ না সাম্প্রদায়িকতার বিষ?]
প্রবীণ রিশাং বলেছিলেন, ‘কাশ্মীরের জঙ্গি কার্যকলাপের চেয়েও ভয়াবহ মণিপুরের সন্ত্রাসবাদ। যখন-তখন যে কেউ অপহৃত হতে পারে।’ রিশাংয়ের সঙ্গে ইম্ফল থেকে তাঁর জন্মভূমি উখরুল জেলার নাগা গ্রামে গিয়েছিলাম। কনভয়ে প্রায় এক ব‌্যাটেলিয়ন সেনা। ওই কনভয় দেখেই ঠাওর হচ্ছিল মণিপুরের এই নাগা গ্রামগুলি রিশাংয়ের মতো উপজাতি সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা নেতাদের পক্ষেও কতটা বিপদসংকুল ছিল। ইম্ফলের সঙ্গে এইসব অঞ্চলের বিস্তর তফাত। প্রত্যেকটা গ্রামই চার্চের ছত্রচ্ছায়ায়। গ্রামবাসীদের সবরকম চাহিদা মেটায় চার্চ। সীমান্তের ওপারে মায়ানমার থেকে অবাধে ঢোকে নানা পণ‌্য। রিশাং গিয়েছিলেন বিধানসভা ভোটের প্রচারে। যত গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা হয়েছিল, সকলেরই উত্তর ছিল, এনএসসিএন যাকে ভোট দিতে ফতোয়া জারি করবে, তাকেই সবাই ভোট দেবে।
রিশাং সম্ভবত মণিপুরের শেষ মুখ‌্যমন্ত্রী, যিনি উপজাতি সম্প্রদায় থেকে এসেছিলেন। এ-রাজ্যের বাকি সব মুখ‌্যমন্ত্রীই সংখ‌্যাগরিষ্ঠ মেইতেই সম্প্রদায়ের। মণিপুরের ৩৫ লক্ষ নাগরিকের ৫৩ শতাংশ মেইতেই সম্প্রদায়ের। এরা প্রায় সকলেই ইম্ফল উপত‌্যকার বাসিন্দা। পাহাড় ও জঙ্গলে বাস করার কারণে উপজাতিরা সংখ‌্যায় মেইতেইদের চেয়ে কম হলেও রাজ্যের ৯০ শতাংশ জমির মালিক। কারণ, রাজ্যের আয়তনের মাত্র ১০ শতাংশ জমি ইম্ফল উপত‌্যকায়। শাসক সম্প্রদায় হওয়া সত্ত্বেও মাত্র ১০ শতাংশ জমির উপর স্বত্বাধিকার মেইতেইদের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন হচ্ছিল। উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ কিন্তু উপত‌্যকাতে এসেও জমি কিনতে পারে। উপজাতি এলাকার জমি কেনার অধিকার নেই মেইতেইদের। এই প্রেক্ষাপটেই মণিপুর হাই কোর্টের নির্দেশ আগুনের ফুলকি হিসাবে কাজ করেছে। বস্তুত, উপত‌্যকার বাসিন্দা মেইতেইরা শিক্ষা, সংস্কৃতির নিরিখে যতেই অগ্রসর হোক না কেন, মুখ‌্যমন্ত্রীরা প্রায় প্রত্যেকেই মেইতেই সম্প্রদায় থেকে আসুন না কেন, অতীতে কিন্তু মেইতেইরা উপজাতির মর্যাদাই পেত। ইদানীং নাগা-কুকিরা তাদের উপজাতি তালিকায় জায়গা দিতে নারাজ। কারণ তাদের আশঙ্কা, নিজেদের জায়গা থেকে উচ্ছেদ হওয়ার। রাজ্যের বর্তমান বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে উচ্ছেদের অভিযোগে বেশ কিছুদিন ধরেই সরব কয়েকটি কুকি সংগঠন।
কুকিদের সংখ‌্যা মণিপুরে লাখ তিনেকের খুব বেশি নয়। মেইতেই সম্প্রদায়কে সংবিধানের তফসিলি উপজাতি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন‌্য কেন্দ্রের উপজাতি বিষয়ক মন্ত্রককে এক মাসের মধ্যে সুপারিশ করতে রাজ‌্য সরকারকে মণিপুর হাই কোর্ট নির্দেশ দেওয়ার পরেই এই কুকিরাই প্রথম স্তব্ধ করে দেয় জনজীবন। মায়ানমারের বেশ কিছু সংগঠনের মদতে মণিপুরে ৩০-৪০ জন যুবকের পক্ষে জঙ্গি কার্যকলাপ শুরু করে দেওয়া কোনও দিনই খুব একটা অসম্ভব ব‌্যাপার ছিল না। এবারও তার ব‌্যতিক্রম হয়নি। উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজনীতির এটাই একটা বিপজ্জনক দিক। আপাতত নিয়ন্ত্রণে এলেও মণিপুরের এই ভয়াবহ জাতি-দাঙ্গা কোথায় গিয়ে শেষ হবে, তা এখনও অস্পষ্ট। জাতি-দাঙ্গায় ধর্মের রং লেগেছে। মেইতেইদের সিংহভাগ বৈষ্ণব। কুকি উপজাতিরা খ্রিস্টান। দাঙ্গায় মন্দির ও চার্চ, দুইই পুড়েছে যথেচ্ছ।
মণিপুরের এই দাঙ্গায় যেমন বিজেপি নেতৃত্ব অদ্ভুতভাবে চুপ, তেমনই পদকজয়ী কুস্তিগিরদের যন্তরমন্তরে ধরনা প্রায় একমাস চলতে থাকলেও কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও হেলদোল নেই। কুস্তি ফেডারেশনের অভিযুক্ত কর্তা ও দলের সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে কোনও ব‌্যবস্থা নিতে যেন নারাজ বিজেপি। দেশ উত্তাল হলেও মোদি-শাহদের মুখে কুস্তিগিরদের নিয়ে টুঁ শব্দটি নেই। রাজনৈতিক মহলের দাবি, ব্রিজভূষণ উত্তরপ্রদেশের আরও পাঁটি লোকসভা আসন জেতার ক্ষেত্রে ‘ফ‌্যাক্টর’ বলেই নাকি বিজেপির চুপ থাকার নীতি। আসলে ভোটের হিসাব কষেই যে তারা একমাত্র রাজনৈতিক পদক্ষেপ করে, মণিপুর ও কুস্তিগিরদের ঘটনায় বুঝিয়ে দিচ্ছে বিজেপি। মণিপুরের দাঙ্গা ভোটারদের মেরুকরণে কাজ দিচ্ছে। কারণ, এখানে ধর্মের রং রয়েছে। কুস্তিগিরদের ক্ষেত্রে নিশ্চিত করেই এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা যে, ধরনায় বসে গেলেই সরকারকে টলিয়ে দেওয়া যাবে না। দাবি যুক্তিসঙ্গত হলেও সরকার ততক্ষণ মাথা নত করবে না, যতক্ষণ তা ভোটবাক্সকে আঘাত করছে না।
[আরও পড়ুন: মিথ্যে বেচার কৌশল! ক্রেমলিনে ড্রোন আক্রমণের নেপথ্য কাহিনি কী?]

Source: Sangbad Pratidin

Related News
মেয়ের জন্ম দেওয়ায় স্বামীর অত্যাচার, আত্মহত্যার চেষ্টা বধূর, বাঁচালেন এক মহিলাই
মেয়ের জন্ম দেওয়ায় স্বামীর অত্যাচার, আত্মহত্যার চেষ্টা বধূর, বাঁচালেন এক মহিলাই

ধীমান রায়, কাটোয়া: ভালবেসে প্রেমিকের হাত ধরে বাড়ি ছেড়েছিলেন তরুণী। বিয়ের বছর দেড়েকের মধ্যেই মোহভঙ্গ। কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ায় স্বামীর কাছে Read more

গুলি-বোমা ভুলে উন্নয়নের মন্ত্রে মজে শাসন, মজিদ মাস্টারের ‘ডেরা’ এখন পোড়ো বাড়ি
গুলি-বোমা ভুলে উন্নয়নের মন্ত্রে মজে শাসন, মজিদ মাস্টারের ‘ডেরা’ এখন পোড়ো বাড়ি

অর্ণব দাস: বোমা, গুলি, হুমকি, লাগামছাড়া সন্ত্রাস। একটা সময় এগুলো কার্যত রোজনামচা ছিল শাসনের বাসিন্দাদের কাছে। আতঙ্ককে সঙ্গে নিয়েই দিনাতিপাত করতেন Read more

Abhishek Banerjee: TMC’র ভয়ে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বদল! উপনির্বাচনের প্রচারে একাধিক ইস্যুতে বিজেপিকে খোঁচা অভিষেকের
Abhishek Banerjee: TMC’র ভয়ে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বদল! উপনির্বাচনের প্রচারে একাধিক ইস্যুতে বিজেপিকে খোঁচা অভিষেকের

সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: চলতি মাসের শেষে ত্রিপুরার (Tripura) ৪ আসনে বিধানসভা উপনির্বাচন। আর সেই ভোটের প্রচারে ত্রিপুরায় বিশাল ব়্যালি Read more

১৪ বছর ধরে রাতে খাবার খান না মনোজ বাজপেয়ী! ফিট থাকার মন্ত্র ফাঁস করলেন অভিনেতা
১৪ বছর ধরে রাতে খাবার খান না মনোজ বাজপেয়ী! ফিট থাকার মন্ত্র ফাঁস করলেন অভিনেতা

সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ফিট থাকতে খেতে হবে অল্প! হ্য়াঁ, এমনটা শুধু বিশ্বাস করেন না বলিউড অভিনেতা মনোজ বাজপেয়ী, বরং Read more

Mukul Roy: মুকুল রায় বিধায়ক থাকতে পারবেন তো? স্পিকারকে সিদ্ধান্ত জানানোর সময় বেঁধে দিল সুপ্রিম কোর্ট
Mukul Roy: মুকুল রায় বিধায়ক থাকতে পারবেন তো? স্পিকারকে সিদ্ধান্ত জানানোর সময় বেঁধে দিল সুপ্রিম কোর্ট

সোমনাথ রায় নয়াদিল্লি: মুকুল রায়ের (Mukul Roy) বিধায়ক পদ কি থাকবে? সিদ্ধান্ত হোক ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে, স্পিকারকে সিদ্ধান্ত জানানোর Read more

বাসে উঠলে দিতে হবে না ভাড়া, রাখি উপলক্ষে উত্তরপ্রদেশের মহিলাদের ‘উপহার’ যোগীর
বাসে উঠলে দিতে হবে না ভাড়া, রাখি উপলক্ষে উত্তরপ্রদেশের মহিলাদের ‘উপহার’ যোগীর

সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: রাখিবন্ধন (Raksha Bandhan) উপলক্ষে বড় ঘোষণা যোগী সরকারের। উত্তরপ্রদেশের (Uttar Pradesh) মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ (Yogi Adityanath) Read more