প্রতি মিনিটে ৩-৪টি বই বিক্রি

এখন ‘তারকা-লেখক’ শব্দবন্ধ অক্সিমোরন এই বাংলায়। এমন ক্রান্তিকালে, বাংলার ‘লাস্ট অফ দ্য মোহিকান্‌স’, ‘তারকা-লেখক’ সমরেশ মজুমদার চলে গেলেন। আক্ষরিক অর্থে কালবেলা! লিখলেন ইন্দ্রনীল সান্যাল।
সমরেশ মজুমদারকে সামনাসামনি প্রথম দেখি ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘বাড়িওয়ালি’ ছবিটি রিলিজ করার দিন, ‘নন্দন’-এ। দীর্ঘদেহী, পাজামা-পাঞ্জাবি পরা মানুষটি ফয়্যারে একা দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলেন। আমার খুব ইচ্ছা করছিল গিয়ে কথা বলার, কিন্তু বলে উঠতে পারিনি। একটু পরে এক সুন্দরী মহিলা কবি এসে ওঁর সঙ্গে আড্ডা জমালেন। পরের দিন, স্মৃতি যদি ঠিক কাজ করে, ওঁর করা ‘বাড়িওয়ালি’-র সমালোচনা একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।
ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম, ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ২০০০ সালে। আর স্মৃতি ছেনে বুঝলাম, আমি সমরেশ মজুমদারকে প্রথম চিনতে শুরু করেছিলাম ‘উত্তরাধিকার’ পড়ে। আমি তখন নেহাতই ছোট। স্বর্গছেঁড়া আর জলপাইগুড়ি হয়ে কলকাতা শহর পর্যন্ত একাধিক স্থান জুড়ে, অনেকটা সময়সীমা নিয়ে, লেখা হয়েছিল অনিমেষের বড় হওয়ার এবং বেড়ে ওঠার গল্প। অনিমেষের জীবনের পরের দুই পর্ব ‘কালপুরুষ’ ও ‘কালবেলা’ এল তার কিছুকাল পরে। সেটা আটের দশক, বামফ্রন্ট বাংলার মসনদে। বাংলার জলহাওয়ায় বিপ্লব ম-ম করছে। মাধবীলতা আর অনিমেষের প্রেম নিয়ে বাঙালি পাঠিকা-পাঠকের আকুলতা ছিল দেখার মতো। আমাদের পাড়ায় দেওয়াল লিখন দেখেছি, ‘বিপ্লবের আরেক নাম মাধবীলতা’।
[আরও পড়ুন: কসবার নার্সিংহোমে লিফট দুর্ঘটনায় মৃত্যু মহিলা চিকিৎসকের, সংকটজনক স্বামী]
সেই সময় আমি স্কুলে পড়ি। কিছুটা বোঝার বয়স হয়েছে, অনেকটাই হয়নি। কিন্তু যে-কয়েকজন লেখকের সব লেখা গপগপ করে গিলতাম, তাঁদের মধ্যে একজন অবশ্যই সমরেশ মজুমদার। সাহিত্য পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত ‘সাতকাহন’ বা ‘গর্ভধারিণী’-র মতো উপন্যাস তো বটেই, দৈনিক পত্রিকার রবিবাসরীয়-তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত থ্রিলার ‘বুনো হাঁসের পালক’ পড়েছি শ্বাসরুদ্ধ করে। সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের দিনগুলোয় ভোরবেলা দরজা খুলে অপেক্ষা করতাম কাগজকাকুর জন্য। রবিবারের ক্রোড়পত্র নিয়ে বাড়িতে কাড়াকাড়ি হত। এই ছিল আমাদের বাড়িতে সমরেশ মজুমদারকে নিয়ে ক্রেজ!
আর পুজোসংখ্যার উপন্যাস? সেখানেও একই অবস্থা। ‘তিন নম্বরের সুধারাণী’ বা ‘তীর্থযাত্রী’-র মতো উপন্যাস পড়ে ফেলা যেত ঝড়ের গতিতে। সহজ-সরল গদ্যে তিনি মূল চরিত্রের যাত্রাপথের সঙ্গী করে নিতেন পাঠককে। নায়ক বা নায়িকার জীবনের ওঠাপড়ার গল্প সবাই চট করে আইডেন্টিফাই করতে পারতেন। মুগ্ধ না-হয়ে উপায় নেই। তাঁর উপন্যাসের বিষয়-বৈচিত্র দেখে বিস্মিত হতে হয়! রেসের মাঠ থেকে লালবাতি পাড়া, কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবন থেকে উত্তরবাংলার চা-বাগান, ফিজিওথেরাপিস্ট বা ব্যাংককের কেরিয়ারের জীবন– কী আসেনি তাঁর সীমাহীন ক্যানভাসে?
[আরও পড়ুন: ‘বিশ্বাস ছিল, রিঙ্কু ঠিক জিতিয়েই ফিরবে’, রুদ্ধশ্বাস ম্যাচের পর জানালেন রাসেল]
মিলেনিয়ালরা হয়তো জানবেও না যে, টেলিভিশনে বাংলা ধারাবাহিকের যাঁরা হোতা, তাঁদের মধ্যে ‘সোনেক্স’-এর জোছন দস্তিদার এবং সমরেশ মজুমদার দুই স্তম্ভ। ‘তেরো পার্বণ’, ‘মুক্তবন্ধ’, ‘কলকাতা কলকাতা’– কত না ধারাবাহিকের কাহিনিকার তিনি। আমার মনে আছে, ‘তেরো পার্বণ’-এর একটি এপিসোডে উনি ‘লেখক সমরেশ মজুমদার’ হিসাবে অভিনয়ও করেছিলেন ছোট্ট একটি সিনে। একটি চরিত্রকে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। লেখকরা যে ম্যাজিশিয়ান– সেই থেকে আমি জানি।
সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎ প্রাক্‌-কোভিড জমানার এক পয়লা বৈশাখে, প্রকাশকের ঘরে। তখনই তিনি অল্পবিস্তর অসুস্থ। প্রকাশক আমার সঙ্গে তাঁর আলাপ করিয়ে দেন। তিনি কিছু বলেননি। আমিও টুক করে সরে যাই। ‘বড় পাপ হে’ বা ‘জন্মবৃত্তান্ত’ নামের বাঘা সব ছোটগল্পের লেখকের সঙ্গে কথা বলার সাহস হয়নি।
গত বইমেলায় সেই প্রকাশক বলেছিলেন তাঁদের স্টলে বসতে। কারণ সেই প্রকাশনী থেকে আমার একটি বই বেরিয়েছে। মোটাসোটা উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড। আমি যখন পৌঁছই, তখন সেখানে সমরেশ মজুমদার ছাড়া অন্য কোনও লেখক ছিলেন না। আমি তানা-না-না করে কেটে পড়ার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু প্রকাশকের জোরাজুরিতে বসতে হল। এবং আমি প্রায় সওয়া এক ঘণ্টা বসে থেকে দেখলাম বাংলা ভাষা এখনও লেখকের কীরকম কদর করে। প্রতি মিনিটে ওঁর তিন থেকে চারটি বই বিক্রি হচ্ছিল। কখনও তারও বেশি। উনি অক্লান্ত সই বিলিয়ে যাচ্ছিলেন। আমার বন্ধুস্থানীয় এক চিকিৎসক দম্পতি ওঁর বই কিনে আমাকে বলল ছবি তুলে দিতে। আমার লেখক-সত্তা তখন তলানিতে। টুকটাক সই দেওয়ার ফাঁকে টিপিকাল ফ্যানের মতো মোবাইলে ওঁদের ছবি তুলে দিলাম।
এখন ‘তারকা লেখক’ শব্দবন্ধ অক্সিমোরন হয়ে গিয়েছে, অন্তত এই বাংলায়। এখন ইউটিউবার আর রিল-মেকাররা ‘স্টার’, মেগা সিরিয়ালের নায়িকা বা খলনায়িকারা ‘মেগা তারকা’। অডিও ভিজুয়াল মিডিয়া অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে প্রিন্ট মিডিয়াকে। টেক্সট বুক ছাড়া অন্য বই পড়ার প্রয়োজন ফুরচ্ছে হু হু করে। এমন এক ক্রান্তিকালে, বাংলার ‘লাস্ট অফ দ্য মোহিকান্‌স’, তারকা-লেখক সমরেশ মজুমদার চলে গেলেন।
পঁচিশে বৈশাখের সকালে একে বাংলা সাহিত্যের কালবেলা ছাড়া আর কীই-বা বলতে পারি?

Source: Sangbad Pratidin

Related News
উচ্চবর্ণের সঙ্গে ঝগড়ার শাস্তি! দলিত যুবককে মূত্রপানে বাধ্য করার অভিযোগ, আটক ৮
উচ্চবর্ণের সঙ্গে ঝগড়ার শাস্তি! দলিত যুবককে মূত্রপানে বাধ্য করার অভিযোগ, আটক ৮

সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: জাঠ সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঝগড়া করার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন। এই সাহসের মূল্য চোকাতে হল দলিত যুবককে। বেধড়ক মারধর Read more

বারাকপুরে বিরিয়ানির দোকানে গুলির নেপথ্যও মনীশ শুক্লা খুনের মূলচক্রী! ফের গ্রেপ্তার অভিযুক্ত
বারাকপুরে বিরিয়ানির দোকানে গুলির নেপথ্যও মনীশ শুক্লা খুনের মূলচক্রী! ফের গ্রেপ্তার অভিযুক্ত

অর্ণব দাস, বারাকপুর: বারাকপুরের বিরিয়ানির দোকানে গুলির ঘটনায় গ্রেপ্তার বিজেপি নেতা মণীশ শুক্লা (Manish Shukla) খুনের অন্যতম অভিযুক্ত। জেলে বসেই Read more

ডিপোয় থাকা দাহ্য রাসায়নিকের কথা জানতই না দমকল, বাংলাদেশ অগ্নিকাণ্ডে প্রকাশ্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য
ডিপোয় থাকা দাহ্য রাসায়নিকের কথা জানতই না দমকল, বাংলাদেশ অগ্নিকাণ্ডে প্রকাশ্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য

সুকুমার সরকার, ঢাকা: বাংলাদেশে ঘটা ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে লাফিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী এখনও পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৪৯ Read more

TMC বিধায়কের অফিসের সামনেই দলীয় কর্মীদের বেধড়ক মার, নিশানায় ব্লক সভাপতি
TMC বিধায়কের অফিসের সামনেই দলীয় কর্মীদের বেধড়ক মার, নিশানায় ব্লক সভাপতি

চন্দ্রজিৎ মজুমদার, কান্দি: বিধায়কের অফিসের সামনে মাটিতে ফেলে মারধর করা হল তৃণমূল কর্মীদের। কাঠগড়ায় বিরোধী দল নয়, তৃণমূলেরই ব্লক সভাপতির Read more

Mamata Banerjee on 21st July: ‘আপনাদের আমলে কত চাকরি?’, একুশের মঞ্চ থেকে বামেদের তোপ মমতার
Mamata Banerjee on 21st July: ‘আপনাদের আমলে কত চাকরি?’, একুশের মঞ্চ থেকে বামেদের তোপ মমতার

সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে তোলপাড় রাজ্য। বারবার তৃণমূলকে (TMC) আক্রমণ করছে বাম-বিজেপি। একুশে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে Read more

ঘরের মাঠে ডু প্লেসি-ম্যাক্সির দুরন্ত যুগলবন্দি, লিগ শীর্ষে থাকা রাজস্থানকে হারাল আরসিবি
ঘরের মাঠে ডু প্লেসি-ম্যাক্সির দুরন্ত যুগলবন্দি, লিগ শীর্ষে থাকা রাজস্থানকে হারাল আরসিবি

রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর: ১৮৯/৯ (ডু প্লেসি-৬২ ম্যাক্সওয়েল-৭৭) রাজস্থান রয়্যালস: ১৮২/৬ (যশস্বী-৪৭, দেবদূত-৫২) ৭ রানে জয়ী রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর সংবাদ প্রতিদিন Read more