অরিঞ্জয় বসু: অ্যাসাইলামের জানলা দিয়ে কতটুকু আকাশ দেখা যায়? অ্যাসাইলামের জানলা কতটুকু ধরতে পারে রঙের ভোরাই? অ্যাসাইলামের জানলা কতখানি জানে সৃষ্টির অন্তর্রহস্য? ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের ‘দ্য স্টারি নাইটস’ হয়তো পারবে এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে।
নিজের কান কেটে নেওয়ার মতো আত্মঘাতী কাণ্ডের পর ভ্যান গঘ নিজেই গিয়ে ভরতি হয়েছিলেন দক্ষিণ ফ্রান্সের একটি অ্যাসাইলামে। আর, সেখানে যে-ঘরে থাকতেন, তার জানলা দিয়ে ভোরের আকাশ দেখতে-দেখতে সূর্যাস্তের প্রাক-লগ্নের আশ্চর্য অভিজ্ঞতা সম্বল করে এঁকেছিলেন ‘দ্য স্টারি নাইটস’। সর্বকালের অন্যতম সেরা ছবির তকমা পাওয়া সেই শিল্পকর্ম এবার দুর্গাপুজোয় (Durga Puja 2022) বাঙালির পাতে। বকুলবাগান সর্বজনীন পুজোমণ্ডপে সেই নক্ষত্রখচিত রাতের আবহ তৈরি করেছেন শিল্পী সনাতন দিন্দা। শুধু তা-ই নয়, এই অনবদ্য শিল্পকর্মের সঙ্গে সঙ্গত করে বাজানো হবে আইকনিক রবীন্দ্রগীতি ‘আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ’। থিম পুজোর ভাবনায় ফি-বছর নতুনত্ব আনা হয় নানাভাবে। কিন্তু এমন আন্তর্জাতিক রংমিলান্তি সাম্প্রতিক সময়ে শেষ কবে ঘটেছে, মনে পড়ে না।
[আরও পড়ুন: আপনারা কি চান, আমি বসে যাই! বিরাটকে দিয়ে ওপেন করানোর প্রশ্নে ক্ষুব্ধ রাহুল ]
‘দ্য স্টারি নাইটস’ এঁকেছিলেন ভ্যান গঘ ১৮৮৯ সালের জুন মাসে। অন্যদিকে, ‘গীতবিতান’-এর ‘প্রকৃতি’ পর্যায়ের অন্তর্গত ‘আকাশভরা সূর্য-তারা’ প্রণীত হয়ে ১৯২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। জানার মাঝে অজানার জন্য যে সন্ধান, বিস্ময়ের যে বোধন তা-ই হয়তো ভাবার্থে ভ্যান গঘের ছবিটিকে রবীন্দ্র-গানের অনুসারী করে তুলেছে। করেছে একে-অপরের রসানুগ। এখানেই শেষ নয়। বাজানো হবে লুডভিগ ভ্যান বেঠোভেনের সিম্ফনি, এমনকী রাগ চারুকেশীও।
সনাতন দিন্দা (Sanatan Dinda) ইতিমধ্যে জানিয়েছেন যে, এই বছর তাঁর প্রতিমা-নির্মাণ ও মণ্ডপসজ্জার সঙ্গে জড়িয়ে থাকার ২৫ বছর পূর্তি। প্রথাগত চিন্তা থেকে সরে গিয়ে কিছু ভাবতে চেয়েছিলেন। তারপরই এমন রং ও সুরের আন্তর্জাতিক সংযোগের কথাটি তাঁর মনে আসে।
পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট ঘরানার শিল্পী ভ্যান গঘ এখন বিশ্বের সর্বত্র সমাদৃত। কিন্তু যে ভালবাসা ও গ্রহণযোগ্যতা আজ তৈরি হয়েছে, জীবদ্দশায় এর কণামাত্র তিনি দেখে যেতে পারেননি। খাতায়-কলমে ব্যর্থ ও সাফল্যহীন আয়ুষ্কাল কাটিয়েছেন। না ছিল কোনও গহন প্রেম, না ছিল আঠালো বন্ধুতা, না ছিল সামাজিক স্বীকৃতি। সমকালের মধ্যে একমাত্র ভাই থিও চিনতে পেরেছিলেন তাঁর প্রতিভাকে। থিও-র সাহচর্য না পেলে হয়তো ভ্যান গঘকে একটা স্তরে ছবি আঁকা ছেড়েই দিতে হত। তবে যেটা অবাক করে, জীবন যাঁকে এত বঞ্চিত করেছে, বেরঙিন রেখেছে, তাঁর ছবিতে এত উজ্জ্বল রঙের বিস্ফোরণ কী করে ঘটে?
[আরও পড়ুন: ১৯ তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীর সম্পত্তি বৃদ্ধি মামলায় স্বস্তি, হাই কোর্টের শুনানিতে ‘সুপ্রিম’ স্থগিতাদেশ]
এখানে মনে পড়তে বাধ্য ভ্যান গঘের নিজের বয়ানে বলা এই কথাগুলি যে, ‘The more ugly, old, vicious, ill, poor I get, the more I want to take revenge by producing a brilliant color, well arranged, resplendent.’ রং তাহলে প্রতিশোধের অস্ত্র? দীনতা জয় করার মাধ্যম? স্বীকারোক্তি তা-ই বলছে।
‘ইউনেস্কো’-র আলিঙ্গনে যে-বছর বাংলার দুর্গোৎসব আমোদিত, সেই বছর না হয় ভ্যান গঘের রঙের বাহারেই ঝলসে উঠুক বাংলার পুজোমণ্ডপের দালানবাড়ি। রবীন্দ্র সংগীত আমাদের রক্তধারায় টান দিক নতুন করে। মাতৃবন্দনায় মুখর হয়ে আমরা যেন বলতে পারি: ছড়িয়ে আছে আনন্দেরই গান,/ বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।
Source: Sangbad Pratidin